Sunday, 4 November 2012


অস্তচাঁদে

ভালোবাসিয়াছি আমি অস্তচাঁদ, -ক্লান্ত শেষপ্রহরের শশী!
-অঘোর ঘুমের ঘোরে ঢলে যবে কালো নদী-ঢেউয়ের কলসী,
নিঝ্ঝুম বিছানার পরে
মেঘবৌ'র খোঁপাখসা জোছনাফুল চুপে চুপে ঝরে,-
চেয়ে থাকি চোখ তুলে'-যেন মোর পলাতকা প্রিয়া
মেঘের ঘোমটা তুলে' প্রেত-চাঁদে সচকিতে ওঠে শিহরিয়া!
সে যেন দেখেছে মোরে জন্মে জন্মে ফিরে' ফিরে' ফিরে'
মাঠে ঘাটে একা একা, -বুনোহাঁস-জোনাকির ভিড়ে!
দুশ্চর দেউলে কোন্-কোন্ যক্ষ-প্রাসাদের তটে,
দূর উর-ব্যাবিলোন-মিশরের মরুভূ-সঙ্কটে,
কোথা পিরামিড তলে, ঈসিসের বেদিকার মূলে,
কেউটের মতো নীলা যেইখানে ফণা তুলে উঠিয়াছে ফুলে,
কোন্ মনভুলানিয়া পথচাওয়া দুলালীর মনে
আমারে দেখেছে জোছনা-চোর চোখে-অলস নয়নে!
আমারে দেখেছে সে যে আসরীয় সম্রাটের বেশে
প্রাসাদ-অলিন্দে যবে মহিমায় দাঁড়ায়েছি এসে-
হাতে তার হাত, পায়ে হাতিয়ার রাখি
কুমারীর পানে আমি তুলিয়াছি আনন্দের আরক্তিম আঁখি!
ভোরগেলাসের সুরা-তহুরা, ক'রেছি মোরা চুপে চুপে পান,
চকোরজুড়ির মতো কুহরিয়া গাহিয়াছি চাঁদিনীর গান!
পেয়ালায়-পায়েলায় সেই নিশি হয় নি উতলা,
নীল নিচোলের কোলে নাচে নাই আকাশের তলা!
নটীরা ঘুমায়েছিল পুরে পুরে, ঘুমের রাজবধূ-
চুরি করে পিয়েছিনু ক্রীতদাসী বালিকার যৌবনের মধু!
সম্রাজ্ঞীর নির্দয় আঁখির দর্প বিদ্রূপ ভুলিয়া
কৃষ্ণাতিথি-চাঁদিনীর তলে আমি ষোড়শীর উরু পরশিয়া
লভেছিনু উল্লাস-উতরোল!-আজ পড়ে মনে
সাধ-বিষাদের খেদ কত জন্মজন্মান্তের, রাতের নির্জনে!

আমি ছিনু 'ক্রবেদুর' কোন্ দূর 'প্রভেন্স্'-প্রান্তরে!
-দেউলিয়া পায়দল্-অগোচর মনচোর-মানিনীর তরে
সারেঙের সুর মোর এমনি উদাস রাত্রে উঠিত ঝঙ্কারি!
আঙুরতলায় ঘেরা ঘুমঘোর ঘরখানা ছাড়ি
ঘুঘুর পাখনা মেলি মোর পানে আসিল পিয়ারা;
মেঘের ময়ূরপাখে জেগেছিল এলোমেলো তারা!
-'অলিভ' পাতার ফাঁকে চুন চোখে চেয়েছিল চাঁদ,
মিলননিশার শেষে-বৃশ্চিক, গোক্ষুরাফণা, বিষের বিস্বাদ!

স্পেইনের 'সিয়েরা'য় ছিনু আমি দস্যু-অশ্বারোহী-
নির্মম-কৃতান্ত-কাল-তবু কী যে কাতর, বিরহী!
কোন্ রাজনন্দিনীর ঠোঁটে আমি এঁকেছিনু বর্বর চুম্বন!
অন্দরে পশিয়াছিনু অবেলার ঝড়ের মতন!
তখন রতনশেজে গিয়েছিল নিভে মধুরাতি,
নীল জানালার পাশে-ভাঙা হাটে-চাঁদের বেসাতি।
চুপে চুপে মুখে কার পড়েছিনু ঝুঁকে!
ব্যাধের মতন আমি টেনেছিনু বুকে
কোন্ ভীরু কপোতীর উড়ু-উড়ু ডানা!
-কালো মেঘে কেঁদেছিল অস্তচাঁদ-আলোর মোহানা!

বাংলার মাঠে ঘাটে ফিরেছিনু বেণু হাতে একা,
গঙ্গার তীরে কবে কার সাথে হয়েছিল দেখা!
'ফুলটি ফুটিলে চাঁদিনী উঠিলে' এমনই রূপালি রাতে
কদমতলায় দাঁড়াতাম গিয়ে বাঁশের বাঁশিটি হাতে!
অপরাজিতার ঝাড়ে- নদীপারে কিশোরী লুকায়ে বুঝি!-
মদনমোহন নয়ন আমার পেয়েছিল তারে খুঁজি!
তারই লাগি বেঁধেছিনু বাঁকা চুলে ময়ূরপাখার চূড়া,
তাহারই লাগিয়া শুঁড়ি সেজেছিনু-ঢেলে দিয়েছিনু সুরা!
তাহারই নধর অধর নিঙাড়ি উথলিল বুকে মধু,
জোনাকির সাথে ভেসে শেষরাতে দাঁড়াতাম দোরে বঁধু!
মনে পড়ে কি তা!-চাঁদ জানে যাহা, জানে যা কৃষ্ণাতিথির শশী,
বুকের আগুনে খুন চড়ে-মুখ চুন হয়ে যায় একেলা বসি!

কাজলা দিদি

বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?
পুকুর ধারে লেবুর তলে থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই-
মাগো আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই?
সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ডাকো;-
দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো?
খাবার খেতে আসি যখন, দিদি বলে ডাকি তখন,
ওঘর থেকে কেন মা আর দিদি আসে নাকো?
আমি ডাকি তুমি কেন চুপটি করে থাকো?
বল মা দিদি কোথায় গেছে, আসবে আবার কবে?
কাল যে আমার নতুন ঘরে পুতুল-বিয়ে হবে!
দিদির মত ফাঁকি দিয়ে, আমিও যদি লুকাই গিয়ে
তুমি তখন একলা ঘরে কেমন করে রবে,
আমিও নাই-দিদিও নাই- কেমন মজা হবে।
ভুঁই চাপাতে ভরে গেছে শিউলি গাছের তল,
মাড়াস্ নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল।
ডালিম গাছের ফাঁকে ফাঁকে বুলবুলিটি লুকিয়ে থাকে,
উড়িয়ে তুমি দিও না মা, ছিঁড়তে গিয়ে ফল,-
দিদি এসে শুনবে যখন, বলবি কি মা বল!
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই-
এমন সময় মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
লেবুর ধারে পুকুর পাড়ে ঝিঁঝিঁ ডাকে ঝোপে ঝাড়ে’
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, তাইতে জেগে রই
রাত্রি হলো মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
জীবন, তোকে নিয়ে
                   Srijato Bandopadhyay


ওজনে কম হলে যৌবন 
আঙ্গুলে বড় হলে আংটি
কোথাও তবু ভারসাম্য
বজায় রেখে চলে শান্তি |

পা দিলে পড়ে যাব নির্ঘাত
 
শ্যাওলা পোষে কত কার্নিশ
প্রেমের দিকটায় যাইনা |
রাতের বাসে লং জার্নি...

যেদিকে ঈশ্বর থাকেনা 

সেদিকে মুখ করে পেচ্ছাপ |
ফ্ল্যাটের ছোট-ছোট জানলায়
আদর, প্রবলেম , কেচ্ছা ....

সময়-অসময় দুই ভাই |
 
দুয়ের  খুরে খুরে পেন্নাম
মরে যাবার পর স্বর্গ
মরে ওঠার আগে ঘেন্না !

জীবন, তোকে নিয়ে সকলেই 

লিখেছি তিন-চার ছত্র
সেসব নিয়ে আজ বই হোক-
"সেলিম  লংরে   পে মত রো"  

Sunday, 28 October 2012


নদী-স্বপ্ন – বুদ্ধদেব বসু


কোথায় চলেছো? এদিকে এসো না! দুটো কথা শোনা দিকি
এই নাও- এই চকচকে ছোটো, নুতন রূপোর সিকি
ছোকানুর কাছে দুটো আনি আছে, তোমারে দেবো গো তা-ও,
আমাদের যদি তোমার সঙ্গে নৌকায় তুলে নাও।
নৌকা তোমার ঘাটে বাঁধা আছে- যাবে কি অনেক দূরে?
পায়ে পড়ি, মাঝি, সাথে নিয়ে চলো মোরে আর ছোকানুরে
আমারে চেনো না? মোর নাম খোকা, ছোকানু আমার বোন
তোমার সঙ্গে বেড়াবো আমরা মেঘনা-পদ্মা-শোন।
দিদি মোরে ডাকে গোবিন্দচাঁদ, মা ডাকে চাঁদের আলো,
মাথা খাও, মাঝি, কথা রাখো! তুমি লক্ষী, মিষ্টি, ভালো!
বাবা বলেছেন, বড় হয়ে আমি হব বাঙলার লাট,
তখন তোমাকে দিয়ে দেব মোর ছেলেবেলাকার খাট।
চুপি-চুপি বলি, ঘুমিয়ে আছে মা, দিদি গেছে ইস্কুলে,
এই ফাঁকে মোরে-আর ছোকানুরে- নৌকোয়া লও তুলে।
কোন ভয় নেই – বাবার বকুনি তোমাকে হবে না খেতে
যত দোষ সব, আমার- না, আমি একা ল’ব মাথা পেতে।
নৌকো তোমার ডুবে যাবে নাকো, মোরা বেশি ভারি নই,
কিচ্ছু জিনিস নেবো না সঙ্গে কেবল ঝন্টু বই।
চমকালে কেন! ঝন্টু পুতুল, ঝন্টু মানুষ নয়,
একা ফেলে গেলে, ছোকানুরে ভেবে কাঁদিবে নিশ্চয়।
অনেক রঙের পাল আছে, মাঝি? বাদামী? সোনালী? লাল?
সবুজও? তা হলে সেটা দাও আজ, সোনালীটা দিয়ো কাল।
সবগুলো নদী দেখাবে কিন্তু। আগে চলো পদ্মায়,
দুপুরের রোদে রূপো ঝলমল সাদা জল উছলায়
শুয়ে’ শুয়ে’ – মোরা দেখিব আকাশ- আকাশ ম-স্ত বড়,
পৃথিবীর যত নীল রঙ- সব সেখানে করেছে জড়।
মায়ের পূজোর ঘরটির মত, একটু ময়লা নাই,
আকাশেরে কে যে ধোয় বারবার, তুমি কি জানো তা ভাই?
কালো-কালো পাখি বাঁকা ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলে যায় দূরে,
উঁচু থেকে ওরা দেখিতে কি পায় মোরে আর ছোকানুরে?
রূপোর নদীতে রূপোর ইলিশ- চোখ ঝলসানো আঁশ,
ওখানে দ্যাখো না- জালে বেঁধে জেলে তুলিয়াছে একরাশ।
ওটা চর বুঝি? একটু রাখো না, এ তো ভারি সুন্দর।
এ যেন নতুন কার্পেট বোনা! এই পদ্মার চর?
ছোকানু, চল রে, চান ক’রে আসি দিয়ে সাত-শোটা ডুব,
ঝাঁপায়ে-দাপায়ে টলটলে জলে নাইতে ফুর্তি খুব।
ইলিশ কিনলে? আঃ, বেশ বে তুমি খুব ভালো, মাঝি
উনুন ধরাও ছোকানু দেখাবে রান্নার কারসাজি।
খাওয়া হ’লো শেষ- আবার চলেছি, দুলছে ছোট্ট নাও,
হাল্কা নরম হাওয়ায় তোমার লাল পাল তুলে দাও।
আমর দু’জন দেখি ব’সে ব’সে আকাশ কত না নীল,
ছোট পাখি আরো ছোট হ’য়ে যায়- আকাশের মুখে তিল
সারাদিন গোলা, সূর্য লুকালো জলের তলার ঘরে,
সোনা হ’য়ে জ্বলে পদ্মার জল কালো হ’লো তার পরে।
সন্ধ্যার বুকে তারা ফুটে ওঠে- এবার নামাও পাল
গান ধরো, মাঝি; জলের শব্দ ঝুপঝুপ দেবে তাল।
ছোকানুর চোখ ঘুমে ঢুলে আসে- আমি ঠিক জেগে আছি,
গান গাওয়া হ’লে আমায় অনেক গল্প বলবে, মাঝি?
শুনতে-শুনতে আমিও ঘুমাই বিছানা বালিশ বিনা
– মাঝি, তুমি দেখো ছোকানুরে, ভাই, ও বড়োই ভীতু কিনা
আমার জন্য কিচ্ছু ভেবো না, আমিই তো বড়োই প্রায়,
ঝড় এলে ডেকো আমারে- ছোকানু যেন সুখে ঘুম যায়।

চায়ের দোকানে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়




লণ্ডনে আছে লাস্ট বেঞ্চির ভীরু পরিমল,
রথীন এখন সাহিত্যে এক পরমহংস
দীপু তো  শুনেছি খুলেছে বিরাট কাগজের কল
এবং পাঁচটা চায়ের বাগানে দশআনি অংশ
তদুপরি অবসর পেলে হয় স্বদেশসেবক;

আড়াই ডজন আরশোলা ছেড়ে ক্লাস ভেঙেছিল পাগলা অমল
সে আজ হয়েছে মস্ত অধ্যাপক!
কি ভয়ংকর উজ্জ্বল ছিল সত্যশরণ
সে কেন নিজের কণ্ঠ কাটলো ঝকঝকে ক্ষুরে -
এখনো ছবিটি চোখে ভাসলেই জাগে শিহরণ
দূরে চলে যাবে জানতাম, তবু এতখানি দূরে ?

গলির চায়ের দোকানে এখন আর কেউ নেই
একদা এখানে সকলে আমরা স্বপ্নে জেগেছিলাম
এক বালিকার প্রণয়ে ডুবেছি এক সাথে মিলে পঞ্চজনেই
আজ এমনকি মনে নেই সেই মেয়েটিরও নাম।

কথা আছে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়




বহুক্ষণ মুখোমুখি চুপচাপ, একবার চোখ তুলে সেতু
আবার আলাদা দৃষ্টি, টেবিলে রয়েছে শুয়ে
পুরোনো পত্রিকা
প্যান্টের নিচে চটি, ওপাশে শাড়ির পাড়ে
দুটি পা-ই ঢাকা
এপাশে বোতাম খোলা বুক, একদিন না-কামানো দাড়ি
ওপাশে এলো খোঁপা, ব্লাউজের নীচে কিছু
মসৃণ নগ্নতা
বাইরে পায়ের শব্দ, দূরে কাছে কারা যায়
কারা ফিরে আসে
বাতাস আসেনি আজ, রোদ গেছে বিদেশ ভ্রমণে।
আপাতত প্রকৃতির অনুকারী ওরা দুই মানুষ-মানুষী
দু‘খানি চেয়ারে স্তব্ধ, একজন জ্বলে সিগারেট
অন্যজন ঠোঁটে থেকে হাসিটুকু মুছেও মোছে না
আঙুলে চিকচিকে আংটি, চুলের কিনারে একটু ঘুম
ফের চোখ তুলে কিছু স্তব্ধতার বিনিময়,
সময় ভিখারী হয়ে ঘোরে
অথচ সময়ই জানে, কথা আছে, ঢের কথা আছে।

Saturday, 27 October 2012


পাগলী, তোমার সঙ্গে"
—জয় গোস্বামী



পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন
এর চোখে ধাঁধা করব, ওর জল করে দেব কাদা
পাগলী, তোমার সঙ্গে ঢেউ খেলতে যাব দু'কদম।
অশান্তি চরমে তুলব, কাকচিল
বসবে না বাড়িতে
তুমি ছুঁড়বে থালা বাটি, আমি ভাঙব কাঁচের বাসন
পাগলী, তোমার সঙ্গে বঙ্গভঙ্গ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ৪২ কাটাব জীবন।

মেঘে মেঘে বেলা বাড়বে,
ধনে পুত্রে লক্ষ্মী লোকসান লোকাসান
পুষিয়ে তুমি রাঁধবে মায়া প্রপন্ঞ্চ
ব্যন্জ্ঞন
পাগলী, তোমার সঙ্গে দশকর্ম জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার
সঙ্গে দিবানিদ্রা কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে ঝোলভাত জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে মাংসরুটি কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে নিরক্ষর জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে চার অক্ষর কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে বই দেখব
প্যারামাউন্ট হলে
মাঝে মাঝে মুখ
বদলে একাডেমি রবীন্দ্রসদন
পাগলী, তোমার সঙ্গে নাইট্যশালা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে কলাকেন্দ্র
কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে বাবুঘাট জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দেশপ্রিয় কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে সদা সত্য জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে 'কী মিথ্যুক'
কাটাব জীবন।

এক হাতে উপায় করব,
দুহাতে উড়িয়ে দেবে তুমি
রেস খেলব জুয়া ধরব ধারে কাটাব সহস্র রকম
লটারি,
তোমার সঙ্গে ধনলক্ষ্মী জীবন
কাটাব
লটারি, তোমার সঙ্গে মেঘধন কাটাব জীবন।

দেখতে দেখতে পূজা আসবে,
দুনিয়া চিত্কার করবে সেল
দোকানে দোকানে খুঁজব
রূপসাগরে অরূপরতন
পাগলী, তোমার সঙ্গে পূজাসংখ্যা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে রিডাকশনে কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে কাঁচা প্রুফ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ফুলপেজ কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে লে আউট জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে লে হালুয়া কাটাব জীবন।

কবিত্ব ফুড়ুত্ করবে, পিছু পিছু ছুটব না হা করে
বাড়ি ফিরে লিখে ফেলব বড়ো গল্প
উপন্যাসোপম
পাগলী, তোমার সঙ্গে কথাশিল্প জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে বকবকম কাটাব জীবন।

নতুন মেয়ের সঙ্গে দেখা করব
লুকিয়ে চুরিয়ে
ধরা পড়ব তোমার হাতে,
বাড়ি ফিরে হেনস্তা চরম
পাগলী, তোমার
সঙ্গে ভ্যাবাচ্যাকা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে হেস্তনেস্ত
কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে পাপবিদ্ধ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধর্মমতে কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে পূজা বেদি জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে মধুমালা কাটাব জীবন।

দোঁহে মিলে টিভি দেখব, হাত
দেখাতে যাব জ্যোতিষীকে
একুশটা উপোস থাকবে, ছাব্বিশটা ব্রত উদযাপন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভাড়া বাড়ি জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে নিজ ফ্ল্যাট
কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার
সঙ্গে শ্যাওড়াফুলি জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে শ্যামনগর কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে রেল রোকো জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে লেট স্লিপ কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে আশাপূর্ণা জীবন কাটাব
আমি কিনব ফুল, তুমি ঘর
সাজাবে যাবজ্জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় জওয়ান জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় কিষান কাটাব জীবন।

সন্ধ্যেবেলা ঝগড়া হবে, হবে দুই
বিছানা আলাদা
হপ্তা হপ্তা কথা বন্ধ
মধ্যরাতে আচমকা মিলন
পাগলী, তোমার
সঙ্গে ব্রক্ষ্মচারী জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে আদম ইভ কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে রামরাজ্য জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার
সঙ্গে প্রজাতন্ত্রী কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ছাল চামড়া জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দাঁতে দাঁত কাটাব জীবন।

এর গায়ে কনুই মারব রাস্তা করব
ওকে ধাক্কা দিয়ে
এটা ভাঙলে ওটা গড়ব, ঢেউ খেলব দু দশ কদম
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোঝড় জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে 'ভোর ভয়োঁ' কাটাব জীবন। ::

শূন্যের ভিতরে ঢেউ – শঙ্খ ঘোষ

বলিনি কখনো?
আমি তো ভেবেছি বলা হয়ে গেছে কবে।
এভাবে নিথর এসে দাঁড়ানো তোমার সামনে
সেই এক বলা
কেননা নীরব এই শরীরের চেয়ে আরো বড়ো
কোনো ভাষা নেই
কেননা শরীর তার দেহহীন উত্থানে জেগে
যতদূর মুছে নিতে জানে
দীর্ঘ চরাচর
তার চেয়ে আর কোনো দীর্ঘতর যবনিকা নেই।
কেননা পড়ন্ত ফুল, চিতার রুপালি ছাই, ধাবমান শেষ ট্রাম
সকলেই চেয়েছে আশ্রয়
সেকথা বলিনি? তবে কী ভাবে তাকাল এতদিন
জলের কিনারে নিচু জবা?
শুন্যতাই জানো শুধু? শুন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে
সেকথা জানো না?
চিল্কায় সকাল -বুদ্ধদেব বসু

কী ভালো আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায়
কেমন করে বলি?
কী নির্মল নীল এই আকাশ, কী অসহ্য সুন্দর,
যেন গুণীর কণ্ঠের অবাধ উন্মুক্ত তান
দিগন্ত থেকে দিগন্তে;

কী ভালো আমার লাগলো এই আকাশের দিকে তাকিয়ে;
চারদিক সবুজ পাহাড়ে আঁকাবাঁকা, কুয়াশায় ধোঁয়াটে,

মাঝখানে চিল্কা উঠছে ঝিলকিয়ে।

তুমি কাছে এলে, একটু বসলে, তারপর গেলে ওদিকে,
স্টেশনে গাড়ি এসে দাড়িয়েঁছে, তা-ই দেখতে।
গাড়ি চ’লে গেল!- কী ভালো তোমাকে বাসি,
কেমন করে বলি?

আকাশে সূর্যের বন্যা, তাকানো যায়না।
গোরুগুলো একমনে ঘাস ছিঁড়ছে, কী শান্ত!
-তুমি কি কখনো ভেবেছিলে এই হ্রদের ধারে এসে আমরা পাবো
যা এতদিন পাইনি?

রূপোলি জল শুয়ে-শুয়ে স্বপ্ন দেখছে; সমস্ত আকাশ
নীলের স্রোতে ঝরে পড়ছে তার বুকের উপর
সূর্যের চুম্বনে।-এখানে জ্ব’লে উঠবে অপরূপ ইন্দ্রধণু
তোমার আর আমার রক্তের সমুদ্রকে ঘিরে
কখনো কি ভেবেছিলে?

কাল চিল্কায় নৌকোয় যেতে-যেতে আমরা দেখেছিলাম
দুটো প্রজাপতি কতদূর থেকে উড়ে আসছে
জলের উপর দিয়ে।- কী দুঃসাহস! তুমি হেসেছিলে আর আমার
কী ভালো লেগেছিল।

তোমার সেই উজ্জ্বল অপরূপ মুখ। দ্যাখো, দ্যাখো,
কেমন নীল এই আকাশ-আর তোমার চোখে
কাঁপছে কত আকাশ, কত মৃত্যু, কত নতুন জন্ম
কেমন করে বলি।
রূপালি মানবী - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


রূপালি মানবী, সন্ধ্যায় আজ শ্রাবণ ধারায়
ভিজিও না মুখ, রূপালী চক্ষু, বরং বারান্দায় উঠে এসো
ঘরের ভিতরে বেতের চেয়ার, জানলা বন্ধ দরজা বন্ধ
রূপালী মানবী, তালা খুলে নাও, দেয়ালে বোতাম আলো জ্বেলে নাও,
অথবা অন্ধকারেই বসবে, কাচের শার্সি থাকুক বন্ধ
দূর থেকে আজ বৃষ্টি দেখবে, ঘরের ভিতরে বেতের চেয়ার, তালা খুলে
নাও।
চাবি নেই, একি! ভালো করে দ্যাখো হাতব্যাগ, মন
অথবা পায়ের নিচে কার্
পেট, কোণ উঁচু করে উঁকি মেরে নাও
চিঠির বাক্সে দ্যাখো একবার, রূপালী মানবী, এত দেরি কেন?
বইরে বৃষ্টি, বিষম বৃষ্টি, ঝড়ের ঝাপটা তোমাকে জড়ায়
তোমার রূপালী চুল খুলে দেয়, চাবি খুঁজে নাও-
তোমার রূপালী অসহায় মুখ আমাকে করেছে আরও উৎসুক-
ধাক্ক-মারো না! আপনি হয়তো দরজা খুলবে, পলকাও তালা
অমন উতলা রূপালী মানবী তোমাকে এখন হওয়া মানায় না
অথবা একলা রয়েছে বলেই বৃষ্টি তোমাকে কোনো ছলে বলে
ছুঁতে পারবে না, ফিরতে না তুমি বাইরে বিপুল লেলিহান ঝড়ে-
তালা খুলে নাও।
রূপালী মানবী, আজ তুমি ঐ জানলার পাশে বেতের চেয়ারে
একলা এসব আঁধারে অথবা দেয়ালে বোতাম আলো জ্বেলে নাও
ঠান্ডা কাঁচের শার্সিতে রাখো ও রূপালী মুখ, দুই উৎসুক চোখ মেলে
দাও।
বাইরে বৃষ্টি, বিষম বৃষ্টি, আজ তুমি ঐ রূপালী শরীরে
বৃষ্টি দেখবে প্রান্তরময়, আকাশ মুচড়ে বৃষ্টির ধারা…
আমি দূরে এক বৃষ্টির নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছি, একলা রয়েছি,
ভিজেছে আমার সর্ব শরীর, লোহার শরীর, ভিজুক আজকে
বাজ বিদ্যুৎ একলা দাঁড়িয়ে মানি না, সকাল বিকেল
খরচোখে আমি চেয়ে আছি ঐ জানলার দিকে, কাচের এপাশে
যতই বাতাস আঘাত করুক, তবুও তোমার রূপালী চক্ষু-
আজ আমি একা বৃষ্টিতে ভিজে, রূপালী মানবী, দেখবো তোমার
বৃষ্টি না-ভেজা, একা বসে থাকা।।
''বনলতা সেন''
--জীবনানন্দ দাশ

হাজার বছর ধরে আমি পথ
হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের
অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের
ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর
অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক,
চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল
নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার
নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর
সমুদ্রের’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন
সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের
ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে;
বলেছে সে, ‌‌‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের
বনলতা সেন।

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ
মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ
নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির
রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ
জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার
বনলতা সেন।
"ফুল ফুটুক না ফুটুক"
–সুভাষ মুখোপাধ্যায়

ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।
শান-বাঁধানো ফুটপাথে
পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ
কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে
হাসছে।

ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।

আলোর চোখে কালো ঠুলি পরিয়ে
তারপর খুলে -
মৃত্যুর কোলে মানুষকে শুইয়ে দিয়ে
তারপর তুলে -
যে দিনগুলো রাস্তা দিয়ে চলে গেছে
যেন না ফেরে।

গায়ে হলুদ দেওয়া বিকেলে
একটা দুটো পয়সা পেলে
যে হরবোলা ছেলেটা
কোকিল ডাকতে ডাকতে যেত–তাকে ডেকে নিয়ে গেছে দিনগুলো।

লাল কালিতে ছাপা হলদে চিঠির মত আকাশটাকে মাথায় নিয়ে
এ-গলির এক কালোকুচ্ছিত আইবুড়ো মেয়ে
রেলিঙে বুক চেপে ধ’রে
এই সব সাত-পাঁচ ভাবছিল -

ঠিক সেই সময় চোখের
মাথা খেয়ে গায়ে উড়ে এসে বসল;
আ মরণ ! পোড়ারমুখ
লক্ষ্মীছাড়া প্রজাপতি !

তারপর দড়াম করে দরজা বন্ধ হবার শব্দ।
অন্ধকারে মুখ চাপা দিয়ে
দড়িপাকানো সেই গাছ
তখন ও হাসছে।
"কেউ কথা রাখেনি" - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কেউ কথা রাখেনি,
তেত্রিশ বছর কাটলো,
কেউ কথা রাখেনি।

ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমী তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল,
শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে
তারপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেলো, কিন্তু
সেই বোষ্টুমী
আর এলোনা
পঁচিশ বছর প্রতিক্ষায় আছি।

মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও
দাদাঠাকুর
তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো
সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর
খেলা করে!
নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো? আমার
মাথা এ ঘরের ছাদ
ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায়
তিন প্রহরের বিল দেখাবে?

একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনো
লাঠি-লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্করবাড়ির
ছেলেরা
ভিখারীর মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি
ভিতরে রাস-উৎসব
অবিরল রঙের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ
পরা ফর্সা রমণীরা
কত রকম আমোদে হেসেছে
আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি!
বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস, একদিন,
আমরাও…
বাবা এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয়নি কিছুই
সেই রয়্যাল গুলি, সেই লাঠি-লজেন্স, সেই রাস-উৎসব
আমায় কেউ ফিরিয়ে দেবেনা!

বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল,
যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালবাসবে
সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!
ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠেয়ে প্রাণ নিয়েছি
দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়
বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন
করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীল পদ্ম
তবু কথা রাখেনি বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের
গন্ধ
এখনো সে যে-কোনো নারী।

কেউ কথা রাখেনি,
তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখে না!
" নীরার অসুখ "
-- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

নীরার অসুখ হলে কলকাতার সবাই বড় দুঃখে থাকে
সূর্য নিভে গেলে পর, নিয়নের
বাতিগুলি হঠাৎ জ্বলার আগে জেনে নেয়-
নীরা আজ ভালো আছে?

গীর্জার বয়স্ক ঘড়ি, দোকানের রক্তিম লাবণ্য–ওরা জানে
নীরা আজ ভালো আছে!
অফিস সিনেমা পার্কে লক্ষ লক্ষ
মানুষের মুখে মুখে রটে যায়
নীরার খবর
বকুলমালার তীব্র গন্ধ এসে বলে দেয়,
নীরা আজ খুশি!

হঠাৎ উদাস হাওয়া এলোমেলো
পাগলা ঘন্টি বাজিয়ে
আকাশ জুড়ে খেলা শুরু করলে
কলকাতার সব লোক মৃদু
হাস্যে জেনে নেয়, নীরা আজ
বেড়াতে গিয়েছে।

আকাশে যখন মেঘ, ছায়াচ্ছন্ন গুমোট নগরে খুব দুঃখ বোধ।
হঠাৎ ট্রামের পেটে ট্যাক্সি ঢুকে নিরানন্দ জ্যাম চৌরাস্তায়
রেস্তোরাঁয় পথে পথে মানুষের মুখ কালো,
বিরক্ত মুখোস
সমস্ত কলকাতা জুড়ে ক্রোধ আর ধর্মঘট,
শুরু হবে লণ্ডভণ্ড
টেলিফোন পোস্টাফিসে আগুন জ্বালিয়ে
যে-যার নিজস্ব হৃৎস্পন্দনেও হরতাল জানাবে–
আমি ভয়ে কেঁপে উঠি, আমি জানি,
আমি তৎক্ষণাৎ ছুটে যাই, গিয়ে বলি,
নীরা, তুমি মন খারাপ করে আছো?
লক্ষ্মী মেয়ে, একবার চোখে দাও,
আয়না দেখার মতো দেখাও ও-মুখের মঞ্জরী
নবীন জনের মতো কলহাস্যে একবার
বলো দেখি ধাঁধার উত্তর!

অমনি আড়াল সরে, বৃষ্টি নামে,
মানুষেরা সিনেমা ও খেলা দেখতে
চলে যায় স্বস্তিময় মুখে
ট্রাফিকের গিঁট খোলে, সাইকেলের
সঙ্গে টেম্পো, মোটরের সঙ্গে রিক্সা
মিলেমিশে বাড়ি ফেরে যা-যার
রাস্তায়
সিগারেট ঠোঁটে চেপে কেউ কেউ
বলে ওঠে,
বেঁচে থাকা নেহাৎ মন্দ না!
ঘুম ভাঙার পর
-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ঘুম ভাঙার পর যেন আমার মন ভালো হয়ে যায়।
হলুদ-তেল মাখা একটি সকাল,
ঝর্নার জলে বৃষ্টিপাতের মতন শব্দ
ঝুল বারান্দার সামনের বাগানে কেউ হাসছে
শীতের রোদ্দুরের মতন।

কিছু ভাঙছে, কিছু খসে যাচ্ছে
বইয়ের পাতায় কার আঙুল, এখুনি যাবে অন্য পাতায়।
দিগন্ত থেকে ভেসে আসছে বিসর্জনের সুর
ঘুম ভাঙার পর যেন আমার মন ভালো হয়ে যায়।
"কিছু ভাঙছে, কিছু খসে যাচ্ছে
বইয়ের পাতায় কার আঙুল,
এখুনি যাবে অন্য পাতায়।
দিগন্ত থেকে ভেসে আসছে বিসর্জনের সুর
ঘুম ভাঙার পর যেন আমার মন
ভালো হয়ে যায়"


নীরার অসুখ হলে যেখানে সমস্ত শহর জুড়ে থাকে সীমাহীন দুঃখ । সেখানে আজ নীরার প্রেমিক চলে গেলেন শহর ছেড়ে , পৃথিবী ছেড়ে।

কেউ কথা রাখে না, কবিও রাখেননি ।
তিনি বলেছিলেন, আমার তো কারুকে দুঃখ দেবার কথা নয়। অথচ আজ তিনি দুঃখ
দিয়ে ফিরে গেলেন না ফেরার ভিড়ে ।
সিগারেট ঠোঁটে চেপে কেউ আর
বলে উঠবেনা ,
" বেঁচে থাকা নেহাৎ মন্দ না "

বিদায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বিদায় নীললোহিত। দিকশূন্যপুরের আমরা সবাই
আজ তোমার বিদায়ে নীল।

Friday, 19 October 2012

Sunday, 7 October 2012

Wednesday, 3 October 2012

সুরঞ্জনা, অইখানে যেয়োনাকো তুমি, 
বোলোনাকো কথা অই যুবকের সাথে; 
ফিরে এসো সুরঞ্জনা : 
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে; 

ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে; 
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার; 
দূর থেকে দূরে - আরও দূরে 
যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর। 

কী কথা তাহার সাথে? - তার সাথে! 
আকাশের আড়ালে আকাশে 
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ : 
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে। 

সুরঞ্জনা, 
তোমার হৃদয় আজ ঘাস : 
বাতাসের ওপারে বাতাস - 
আকাশের ওপারে আকাশ।

Tuesday, 2 October 2012

Monday, 1 October 2012



                                     শেষ কোথায়??





Saturday, 29 September 2012

                                              নিঃসঙ্গ


Add caption



পরিচিত কিছু মুখ
বাধানো ফ্রেমে এলোমেলো
জীবনের ব্যস্ত স্টেশনে অভিমানী হৃদয়
বিষাদ ছুয়ে একলা বিষন্নতা
অগভীর ইচ্ছের বাধ দিয়ে গুনে যাওয়া ঢেউ
জ্যোৎস্না ভেজা শাড়ির আচল, দুপুরের আনমনা গান
আর বিকেলের খেয়ালী কৃষ্ণচূড়া
পিছু ডেকো না, অবকাশ নেই একলা ভিড়ে
তেমন করে হারানো চিবুক ছুয়ে
শরীর চাইলে আরও বেশি
নরম বুক ছুয়ে, আরও চাইলে
উষ্ণ বিভাজিকা |

Friday, 28 September 2012



তুমি আশ্চর্য ভাবে তাকালে জটিল হয়
জীবনের সম্পর্ক
অলৌকিক স্তব্ধতায় অনন্তের আলোছায়ায়
খুঁজে ফিরি পথ--
এই বুঝি মুখ ফেরানো
শব্দগুচ্ছ মায়াবী পাতার মতন
ভুলতে চেয়েছি বারবার
অথচ দেখো কি ভাবে বদলে যাচ্ছে
জীবনের রঙ!!

                
                  ---by-----SOMSHUVRA

Tuesday, 25 September 2012

Saturday, 22 September 2012

Friday, 21 September 2012

শোনা গেল লাশকাটা ঘরে 
নিয়ে গেছে তারে; 
কাল রাতে - ফাল্গুনের রাতের আধাঁরে 

যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ 
মরিবার হল তার সাধ। বধূ শুয়ে ছিল পাশে - শিশুটিও ছিল; 
প্রেম ছিল,আশা ছিল-জোৎসনায়,-তবে সে দেখিল 
কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেলো তার? 
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল - লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার। 
এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি! 

রক্তফেনা-মাখা মুখে মড়কের ইদুঁরের মত ঘাড় গুজি 
আধার ঘুজির বুকে ঘুমায় এবার; 
কোনোদিন জাগিবেনা আর। 

কোনোদিন জাগিবেনা আর। 
জাগিবার গাঢ় বেদনার 
অবিরাম - অবিরাম ভার 
সহিবেনা আর - 
এই কথা বলেছিলো তারে 
চাঁদডুবে চ’লে গেলে - অদ্ভুদ আঁধারে 
যেন তার জানালার ধারে 
উটের গ্রীবার মতো কোন এক নিস্তব্ধতা এসে। 

তবুও পেঁচা জাগে; 
গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে। 
আরেকটি প্রভাতের ইশারায় - অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে 
টের পাই যুথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে 
চারদিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা 
মশা তার অন্ধকার সংগ্রামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালোবাসে 

রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রোদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি; 
সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কতো দেখিয়াছি। 
ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন - যেন কোন বির্কীন জীবন 
অধিকার ক’রে আছে ইহাদের মন; 
চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বথের কাছে 
একগাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা - একা, 
যে জীবন ফড়িঙের,দোয়েলের-মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা 
এই জেনে। 

অশ্বথের শাখা 
করেনি কি প্রতিবাদ ? জোনাকির ভিড় এসে 
সোনালী ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে 
করেনি কি মাখামাখি? 
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা এসে 
বলেনি কি; ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে 
চমৎকার ! 
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার!’ 
জানায়নি পেঁচা এসে এ-তুমুল গাড় সমাচার ? 

জীবনের এই স্বাদ-সুপক্ক যবের ঘ্রান হেমন্তের বিকেলের- 
তোমার অসহ্য বোধ হ’লো; 
মর্গে কি হৃদয় জুড়ালো 
মর্গে - গুমোটে- 
থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে। 
শোনো 
তবু এ মৃতের গল্প; কোনো 
নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই; 
বিবাহিত জীবনের সাধ 
কোথাও রাখেনি কোন খাদ, 
সময়ের উদ্বর্তনে উঠে এসে বধু 
মধু-আর মননের মধু 
দিয়েছে জানিতে; 
হাড়হাবাতের গ্লানি বেদনার শীতে 
এ-জীবন কোনদিন কেঁপে ওঠে নাই; 
তাই 
লাশকাটা ঘরে 
চিৎ হ'য়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে। 

জানি - তবু জানি 
নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি; 
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয় - 
আর এক বিপন্ন বিষ্ময় 
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে 
খেলা করে; 
আমাদের ক্লান্ত করে, 
ক্লান্ত - ক্লান্ত করে; 
লাশকাটা ঘরে 
সেই ক্লান্তি নাই; 
তাই 
লাশকাটা ঘরে 
চিৎ হ'য়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে। 

তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি,আহা, 
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বত্থের ডালে বসে এসে, 
চোখ পাল্টায়ে কয়: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে ?’ 
চমৎকার ! 
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার- 

হে প্রগাঢ় পিতামহী,আজো চমৎকার ? 
আমিও তোমার মতো বুড়ো হবো-বুড়ি চাঁদটারে আমি 
ক’রে দিবো কালীদহে বেনোজলে পার; 
আমরা দুজনে মিলে শূন্য ক’রে চ’লে যাবো জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।
 

Copyright 2010 Bangla Kobita.

Theme by WordpressCenter.com.
Blogger Template by Beta Templates.